চলছে সেনাবাহিনীর সাথে পাহাড়ি সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর লড়াই, তারই মাঝে সেনাবাহিনীর দলটির নেতৃত্বে থাকা লেফটেন্যান্টের শরীর হলো গুলিবিদ্ধ। বইছে রক্তের ধারা। সবাই ভাবছে তিনি অক্ষত, শুধু তিনিই জানেন ক্ষত কতটা গভীর। আধো আলোয় দাঁড়িয়ে তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন সেনাদের – যেন তার কিছুই হয়নি!
সফল অপারেশন শেষে বুঝতে পেরে তার রানার সৈনিক কাঁদতে কাঁদতে যখন জিজ্ঞাসা করলো –
“স্যার, গুলি লেগেছে বলেননি কেন?” মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, “তোমাদের কিসের ভয়, আমার জীবন তো দেশের চেয়ে আর বড় নয়।”
বলছিলাম বাংলার এক বীর সন্তান, শহিদ লেফটেন্যান্ট জি এম মুশফিকুর রহমান, বীর উত্তম – এর এক বীরত্বগাথার অংশ। তবে তাকে ভালোভাবে বুঝতে হলে জানতে হবে পুরো ঘটনা। তিনি ক্যাম্প কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পান পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম খাগড়াছড়ি জেলার বাঘাইহাট জোনের অন্তর্গত লক্ষীছড়ি ক্যাম্পে। তবে সেই দায়িত্ব কেবল পাহারা দেওয়ার ছিল না, ছিল আত্মত্যাগের, দেশপ্রেমের, আর বীরত্বের অনন্য নজির গড়ার।
৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯। রাতের নিস্তব্ধতায় খবর আসে – কাসালং রিজার্ভ ফরেস্টের ঢেরাছড়া এলাকায় সন্ত্রাসীগোষ্ঠীরা ঘাঁটি গড়ে উঠেছে। সময় তখন ভোর ৩টা ১০ মিনিট। ভয়ডরহীন অফিসার লেফটেন্যান্ট মুশফিক, বিশেষ অপারেশনের নেতৃত্ব কাঁধে নিয়ে রওনা হন গন্তব্যের দিকে – সেই পাহাড়ি শত্রুর আস্তানায়।
শত্রুর আস্তানার কাছে গিয়ে শুরু করেন অপারেশন। ঘায়েল করেন ৩ জন সশস্ত্র বিদ্রোহীকে, উদ্ধার করেন ২টি আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, ইউনিফর্ম এবং গুরুত্বপূর্ণ গোপন দলিলপত্র। সেই রাতে তিনি শুধু একজন সেনানায়কই ছিলেন না – ছিলেন দেশের অদম্য প্রহরী, এক যোদ্ধা, এক কবি। যিনি প্রাণপণ লড়াই করে রচনা করছিলেন সাহসিকতার এক মহাকাব্য।
তবে লড়াইটা সহজ ছিল না, অপারেশনের এক পর্যায়ে তিনি নিজেও হন গুলিবিদ্ধ। কিন্তু আশ্চর্য দৃঢ়তায় তিনি নিজের রক্তাক্ত শরীর লুকিয়ে রেখে অধীনস্থ সেনাদের নির্দেশ দিয়ে যান। তাঁর রক্ত ঝরছিল, কিন্তু নেতৃত্ব ছিল অটুট। অধীনস্থ কেউ বুঝতেই পারেননি, তাদের কমান্ডার পৌঁছে গেছেন মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে ।
অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে ১৯৮৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে শহীদ হন তিনি। তবে রেখে যান সাহস, আদর্শ আর দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
তাঁর এই অতুলনীয় বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯০ সালের ২৫ জানুয়ারি তাঁকে মরণোত্তর “বীর উত্তম” খেতাবে ভূষিত করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের মধ্যে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভূষিত হন ‘বীর উত্তম’ উপাধিতে ।
এছাড়াও এই কিংবদন্তির স্মৃতিকে অমর রাখতে লক্ষীছড়ি ক্যাম্পের নামকরণ করা হয়েছে – “শহিদ লেফটেন্যান্ট জি এম মুশফিকুর রহমান আর্মি ক্যাম্প”।
বাংলার ইতিহাসে যতদিন থাকবে দেশপ্রেম, ত্যাগ আর সাহসের গল্প, ততদিন বেঁচে থাকবেন লেফটেন্যান্ট মুশফিক।তিনি ছিলেন এমন এক রক্তিম সূর্য, যিনি নিজে অস্ত গেলেন, কিন্তু আরো আলোকিত করে গেলেন সেনাবাহিনীর মহান ইতিহাসকে।
স্বাধীনতার পরে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিটি ধূসর পাহাড়, ঘন অরণ্য আর ঝরনাধারায় লুকিয়ে আছে অগণিত বীরত্বগাথা। এই ইতিহাসের পাতায় একটি নাম চিরকাল ঝলমল করবে – ‘শহিদ লেফটেন্যান্ট জি এম মুশফিকুর রহমান, বীর উত্তম’।


